Saturday, 29 March 2025

"জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।": এক চিরন্তন সত্য

"জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।"

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের এই গভীর উক্তি কেবল একটি আধ্যাত্মিক মতবাদ নয়, এটি মানবতা ও সমগ্র জীবজগতের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক চিরন্তন সত্য। এখানে 'প্রেম' বলতে কেবল আবেগ নয়, বরং এটি নিঃস্বার্থ সেবা, সহানুভূতি এবং অপরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার এক মহত্তম রূপ। ভালোবাসা যদি এক আবেগ হয়, তবে প্রেম হল তার পরিপূর্ণ বিকাশ—যেখানে স্বার্থপরতা বিলীন হয়ে যায় এবং কেবলমাত্র অপরের কল্যাণই মুখ্য হয়ে ওঠে। তাই, যখন রামকৃষ্ণ বলেন 'জীবকে প্রেম করা ঈশ্বরের সেবা করার সমান', তখন তিনি শুধুমাত্র মানুষের কথাই বলেননি, বরং সমগ্র জীবজগতের প্রতি ভালোবাসাকে ঈশ্বরের সেবার অন্যতম রূপ হিসেবে তুলে ধরেছেন।

ঈশ্বর: এক সার্বজনীন চেতনা

ঈশ্বর কি শুধুমাত্র এক ধারণা, নাকি এক গভীর চেতনা এবং অভিজ্ঞতা? কেউ তাঁকে চোখে দেখেনি, কিন্তু অনুভব করতে পারে নিঃস্বার্থ প্রেম, ভালোবাসা ও সেবার মাধ্যমে। ঈশ্বর শুধুমাত্র মানুষের জন্য নন, প্রতিটি জীবের মধ্যেই তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে। একটি পিপড়ের জীবন যেমন মূল্যবান, তেমনই একটি পাখির বা অন্য কোনো জীবজন্তুর জীবনও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি জীবেরই এই পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। আমরা যেমন ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তেমনই তাঁর সৃষ্টির প্রতিও সমান শ্রদ্ধা থাকা উচিত। কারণ, ঈশ্বর কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কোনো রূপে সীমাবদ্ধ নন—তিনি পঞ্চভূতের শক্তির প্রতিফলন, যাঁর প্রকাশ আমরা প্রকৃতির মধ্যে দেখতে পাই এবং যাঁকে সর্বোচ্চ বলে মানি।

মানুষের চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা হলো সেই ঐশ্বরিক শক্তিকে উপলব্ধি করা, গ্রহণ করা এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করা। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াই ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকৃত বহিঃপ্রকাশ। এটাই আমাদের পূজা এটাই আমাদের প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে। আজ আমরা পরিবেশের স্থিতিশীলতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলছি, যা মূলত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান—মাটি, জল, বায়ু, অগ্নি ও আকাশ—এই পঞ্চভূতই ঈশ্বরের শক্তির প্রকাশ। এই শক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে তবেই আমরা প্রকৃত ঈশ্বরচেতনার দিকে এগিয়ে যেতে পারব।

সেবা: সর্বোত্তম উপাসনা

আচার-অনুষ্ঠান, প্রার্থনা এবং তীর্থযাত্রা বিশ্বাস প্রকাশের প্রচলিত উপায়, কিন্তু দয়া ছাড়া তা অসম্পূর্ণ। ভাবুন তো—একজন সৃষ্টিকর্তা কি শুধু প্রশংসার কথায় খুশি হবেন, নাকি তাঁর সৃষ্টির প্রতি প্রেম, ভালোবাসা ও সহানুভূতিতে? যখন আমরা সাহায্যের হাত বাড়াই, কারও কষ্ট লাঘব করি বা প্রয়োজনীয় কাউকে সহযোগিতা করি, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে প্রেম, ভালোবাসা, শান্তি এবং সৌহার্দ্য ছড়িয়ে দেই।এই কাজের মধ্য দিয়েই আমরা ঈশ্বরের সেবা করি।

সেবার অনুপ্রেরণাদায়ক কাহিনি

ইতিহাস জুড়ে, মহান আধ্যাত্মিক নেতা, সাধু এবং মানবহিতৈষীরা সেবাকে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিকতা হিসেবে তুলে ধরেছেন।

  • মাদার তেরেসা অসুস্থ ও দরিদ্রদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, নিঃস্বার্থ সেবার মধ্যেই ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন।

  • মহাত্মা গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে নিঃস্বার্থ সেবা ঈশ্বরকে উপলব্ধির একমাত্র পথ।

  • স্বামী বিবেকানন্দ বারবার বলেছিলেন যে, মানবতার প্রতি নিঃস্বার্থ সেবা করাই ঈশ্বরের সেবা।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও আমরা এর প্রতিফলন দেখি—চিকিৎসকরা রোগীদের সুস্থ করেন, শিক্ষকরা শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়েন, স্বেচ্ছাসেবীরা ক্ষুধার্তদের খাদ্য সরবরাহ করেন। এই সেবাগুলি শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়; বরং প্রকৃত পূজার রূপ।

ভ্রমের বাঁধন ভাঙা

অনেকেই আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও দৈনন্দিন কাজের মধ্যে বিভক্ত জীবন যাপন করি। আমরা আমাদের চারপাশের মানুষদের প্রতি কি সত্যিই সদয় হই? এই বিভ্রম ভাঙার আসল চ্যালেঞ্জ হলো বুঝতে পারা যে ঈশ্বর কোনো দূরবর্তী রূপ নয়, বরং তিনি প্রতিটি জীবের মধ্যেই বিরাজমান।

ঈশ্বরের গুণ অর্জন করাই প্রকৃত সাধনা

যদি আমরা সত্যিই ঈশ্বরের কাছাকাছি যেতে চাই, তবে আমাদের উচিত ঈশ্বরের গুণাবলী অর্জন করা। পঞ্চভূতের শক্তির মধ্যে আমরা যে গুণগুলি দেখতে পাই, সেই গুলোই ঈশ্বরের গুণাবলী এবং সেটা আমাদের জীবনেও প্রয়োগ করা উচিত। যেমন:

  • পবিত্রতা বজায় রাখা

  • শক্তি অর্জন করা

  • নিঃস্বার্থ প্রেম ও ভালোবাসা চর্চা করা

  • জ্ঞান অর্জন করা

  • শান্তি বজায় রাখা

  • সেবার আনন্দ অনুভব করা

  • সরলতার সাথে বর্তমানে বাঁচতে শেখা

এই গুণগুলিই ঈশ্বরের প্রকৃত চেতনার প্রতিফলন। আমরা যদি প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারি, তবে ঈশ্বরের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, প্রেম ও ভালোবাসাও সঠিক পথ খুঁজে পাবে।

আমরা কীভাবে এই চিন্তাধারা প্রয়োগ করতে পারি?

  1. ছোট থেকে শুরু – বড় কিছু করতে হবে না, সামান্য দয়ালু আচরণ—সহকর্মীকে সাহায্য করা, বন্ধুকে সান্ত্বনা দেওয়া, কিংবা একটি অনাহারী প্রাণীকে খাওয়ানো—অত্যন্ত মূল্যবান।

  2. অন্যদের মধ্যে ঈশ্বরকে – কাউকে বিচার করার আগে মনে করা, তিনিও ঈশ্বরেরই সৃষ্টি।

  3. সমাজসেবায় যুক্ত – কমিউনিটি সেবায় অংশ নেওয়া, কাউকে মেন্টর করা, বা প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ান।

  4. সহানুভূতি/কৃতজ্ঞতা চর্চা – প্রকৃত সেবা আসে অন্যের দুঃখ বুঝে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্যের হাত বাড়ানোর মধ্যে।

সর্বোচ্চ উপলব্ধি

আধ্যাত্মিকতার প্রকৃত স্বরূপ বিচ্ছিন্নতায় নয়, বরং সংযোগে। যখন আমরা কেবল আনুষ্ঠানিক উপাসনার পরিবর্তে প্রকৃত সেবায় মনোনিবেশ করি, তখন ঈশ্বরের সাথে গভীর ও তৃপ্তিকর সম্পর্ক অনুভব করি।

তাই, পরবর্তীকালে যখন ঈশ্বরের কথা ভাববেন, মনে রাখবেন—তিনি শুধু উপাসনালয়ে নন, তিনি প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের মধ্যে, প্রতিটি জীবের মধ্যে বিরাজমান। তাঁদের নিঃস্বার্থ সেবা করাই ঈশ্বরের প্রকৃত সেবা।

কারণ, ঈশ্বর আর কেউ নন, তিনি প্রেম ও ভালোবাসা স্বয়ং।


No comments:

Post a Comment